শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩০ অপরাহ্ন
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাত ও মহাসড়ক দখল করে বর্গফুট হিসেবে দোকান বসিয়ে মোটা অংকের অগ্রিম নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও সড়ক-মহাসড়কের কোথাও দু’লাইন, কোথায় চার লাইনে দোকান বসিয়ে হকার্সদের কাছ থেকে প্রতিদিনই দোকান ভেদে বিভিন্ন অংকের চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে মানুষের চলাচলের ফুটপথ ও মহাসড়ক হকার্সদের দখলে থাকায় পথচারীদের চলাচলের কোনো অবস্থা নেই। তাই তারা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন ব্যস্ততম মূল মহাসড়ক দিয়ে। ফলে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত পথচারীরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে বিষয়টি নিয়ে উদাসীন রয়েছেন।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, সাভার বাসস্ট্যান্ডের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের উভয় পাশের নির্মাণাধিন ড্রেনের উপর এবং দুই পাশে ভাসমান দোকান গড়ে উঠেছে। মহাসড়কের পূর্ব পাশে স্মরণিকা আবাসিক এলাকার মূল ফটকের সামনে থেকে শুরু হয়ে রানা প্লাজার সামনে পর্যন্ত পুরো এলাকা জুড়ে প্রায় ৪ শ’ ভাসমান দোকান বসানো হয়েছে। সড়কের পূর্ব পাশে মাশরুম সেন্টারের সামনে থেকে মনসুর মার্কট পর্যন্ত প্রায় ৩শ’ দোকান রয়েছে। এসব ভাসমান দোকান মূল সড়ক ও ফুটপাতের উপর বেশির ভাগ স্থানে ৪ লাইনে দোকান বসানো হয়েছে। এখন বাসস্ট্যান্ডে ফুটপথ ও মহাসড়কে দোকান বসানোর মতো কোথাও কোন জায়গা ফাঁকা নাই।
মাশরুম সেন্টারের সামনে থেকে সিটি সেন্টার পর্যন্ত প্রায় ১০টি চায়ের দোকান সবগুলোই রয়েছে ড্রেনের স্লাবের উপর। আর একটু সামনে রাজ্জাক প্লাজার পাশে প্রাণিসম্পদ অফিসের দেয়ালের সাথে ড্রেনের স্লাপের উপর ও তার পাশে দুই দিকে দোকান বসানোর ফলে পথচারিদের চলতে হয় মূল সড়ক দিয়ে। সেই সাথে সাভার প্রাণিসম্পদ অফিসের মূল ফটক বন্ধ করে বসানো হয়েছে ভাসমান দোকান। ফলে ওই অফিসে সেবা নিতে আসা মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অফিসের পাশেই নিহারিকা হোটেলের হালিমের ডেক রাখা হয়েছে ড্রেনের স্লাবের উপর এবং তার উপরেই গরম তেলে ভাজা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের খাবার। একই চিত্র দেখা যায় পল্লী মার্কেট, ইউনাইটেড মার্কেট, চৌরঙ্গী সুপার মার্কেট, জনতা মার্কেট, হর্টিকালচার সেন্টার ও সাভার নিউ মার্কেটের সামনে। এছাড়াও ওভার ব্রিজ দুটিও ভাসমান দোকানে ভরপুর দেখা গেছে।
সালমা আক্তার নামের আরেক পথচারী বলেন, সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকার ফুটপাত দখল থাকায় রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হয়, যা পথচারীদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। বেশিরভাগ সময় রাস্তায় প্রচণ্ড যানবাহনের চাপ থাকে এবং মহাসড়কের কাজ চলমান থাকায় রাস্তা দিয়েও চলাচল করা যায় না। এর জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
আরেক নারী পথচারী বলেন, ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় অনেক মানুষের ধাক্কা খেতে হয়। বিশেষ করে নারী শিশু ও বৃদ্ধ পথচারীদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় সব থেকে বেশি।
বয়স্ক পথচারী আনিছ হাওলাদার জানান, সরকারি জায়গা দখল করে দোকান বসিয়ে চাঁদা আদায় হচ্ছে অথচ প্রশাসন নীরব থাকে। এ নীরবতার রহস্য খুঁজে বের করা উচিত। তিনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে সড়ক-মহাসড়কগুলো মানুষের চলাচলের ব্যবস্থা করে দেওয়ার আহবান জানান।
ফুটপাত দখল করে থাকা বিভিন্ন দোকানির সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি বলেন, সরকারি জায়গার ‘মালিক’ অনেক। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই সরকারের লোকজন ফুটপথে দোকান বসায়। তাদের দাপটও অনেক। সেইে ‘মালিক’দের ‘টাকা দিয়ে দোকান বসাইছি, আবার তাদের প্রতিদিন চাঁদাও দিতে হয়। শুনি পুলিশ, সড়ক ও জনপথের কর্তা ব্যক্তি, দলীয় নেতাসহ বিভিন্ন জায়গায় চাঁদার টাকা দিতে হয়।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের এসব ফুটপাত দীর্ঘদিন ধরেই দখল হয়ে আছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ফুটপাতে হকাররা ব্যবসা করলেও এর নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। হকারদের জিম্মি করে এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিনই আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা।
ব্যবসায়ী ও হকারদের দেয়া তথ্যে অনুযায়ী, এককালিন প্রতিটি দোকানের জন্য ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পজিশন বুঝে অগ্রিম দিতে হয়। এরপর দোকান প্রতি ৩০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এ চাঁদার টাকা বিভিন্ন সংগঠনের নেতা ও সংস্থার কাছে সপ্তাহ হিস্যা মতো পৌঁছে যায়। এ চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। থানায় মামলাও হয়েছে। অথচ প্রশাসন নির্বিকার।
তবে বেশিরভাগ দোকানিরা বলেছেন, চাঁদা দিয়ে দোকান করতে হলেও আমাদের ব্যবসাতো হয়। ছেলে সন্তান নিয়ে দু’মুঠো ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি। আমরা চাই মানুষও হাঁটুক, আমাদেরও ব্যবসা হোক। কিন্তু চাঁদাবাজ নেতাদের অতিলোভের কারণে আমাদের সমস্যা হচ্ছে।
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের উভয় পাশে হকার্স সংগঠনের চাঁদাবাজির দায়ে গত ২৮ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার এক চাঁদাবাজকে আটক করা হয়। পরদিন বাংলাদেশ হকার্স লীগের সাভার পৌর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক তারেক বীন ওবায়েদ বাদী হয়ে আটক জুয়েল (৪০)কে প্রধান আসামী করে ৫ জনের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় মামলা (নং-৬৫) দায়ের করে। এ ঘটনায় মাত্র ৩ দিন ফুটপাতে চাঁদা আদায় বন্ধ ছিলো। এ সময় হকার্সদের মধ্যে উৎফুল্লতা বিরাজ করেছিলো। এর মাত্র ২দিন পরেই আসামীরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে ফিরে এসে পুনরায় চাঁদাবাজি শুরু করে।
এ ঘটনায় হকার্সদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। এরপর গত ২ জানুয়ারি দৈনিক ফুলকিতে ‘সাভার বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাতে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে’ শিরোনামে সংবাদ প্রচারের পর ১৩ দিন ফুটপাতের পূর্বপাশে চাঁদা তোলা বন্ধ রাখে হকার্স সংগঠনগুলো। তবে পশ্চিম পাশের চাঁদা তোলা চলমান ছিলো। গত সোমবার থেকে আবার নতুন করে চাঁদা তোলা শুরু হয়েছে বলে হকার্সরা জানায়।
এছাড়াও বার বার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না দুটি ওভার ব্রিজের ওপরে থাকা দোকানগুলো। গত ১৬ জানুয়ারি ওভার ব্রিজ দুটিতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে হকার্সদের উচ্ছেদে করে এবং ৭ জনকে আটক করে। এরপরের দিনই আবার দখল হয়ে যায় ওভার ব্রিজ দুটি।
সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এমনিতেই সরকারি-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট রয়েছে। এছাড়াও ব্যস্ততম মহাসড়ক হওয়ায় ফুটপাত ও রাস্তাঘাট প্রতিদিনই মানুষের চলাচলে ব্যস্ত থাকে। তাই দ্রুত ফুটপাত দখলমুক্ত করে পথচারিদের চলাচলের সুযোগ করে দেওয়ার দাবি জানান পথচারীরা।
এ বিষয় সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও এবিষয়ে সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ফোনে একাধিক বার ফোন করেও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।