মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩৫ অপরাহ্ন
অনলাইন রিপোর্ট: সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আটকে আছে প্রায় অর্ধশত চাঞ্চল্যকর মামলার চূড়ান্ত বিচার। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ও ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রিভিউ আবেদনও রয়েছে।
শুনানির ব্যাপারে রাষ্ট্র এবং আসামিপক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। কবে নাগাদ শুনানি হবে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। ঝুলে থাকা এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারপ্রার্থী ও আসামি উভয়পক্ষই হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বিচারপ্রার্থীরা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে আসামিরাও নির্জন কারাগারের কনডেম সেলে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন।
এদিকে নুসরাত জাহান রাফি হত্যা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, দশট্রাক অস্ত্র মামলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলা ও কোটালীপাড়ায় বোমা হামলাসহ বেশকিছু মামলা হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
সুপ্রিমকোর্টের একটি সূত্র জানায়, রাফি হত্যা মামলার রায়সহ সকল নথিপত্র হাইকোর্টে পৌঁছার পর তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। পেপারবুক তৈরির কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। যদিও আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, রাফি হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করবেন।
বিচার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিম্ন আদালতগুলোতে চাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও উচ্চ আদালতে চলছে খুব ধীরগতিতে। এতে হাইকোর্ট বিভাগে মামলাজট তৈরি হয়েছে। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘কয়েকটি মামলা আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে।
এসব মামলা কীভাবে দ্রুত শুনানি করা যায় সে বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হবে। আর রাফি হত্যার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে এসেছে। এখন মামলার পেপার বুক তৈরির পর সেটি শুনানির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সরকার আন্তরিক। সেজন্যই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৪টি এবং আপিল বিভাগে ২১ হাজার ৮১৩টি মামলা বিচারাধীন আছে। আর হাইকোর্টে ৭৩৭টি মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে। বর্তমানে ২০১৪ সালে আসা মামলার ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে।
এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকাকালে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর মামলার ডেথ রেফারেন্স অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির উদ্যোগ নেন। এসব মামলার পেপারবুক তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা হয়েছিল।
এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, সিলেটের রাজন হত্যা ও পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা মামলাটি হাইকোর্টের বিচার শেষে আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। আর পিলখানা হত্যা মামলাটি হাইকোর্টে রায়ের পর এখন পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায়।
রাজন হত্যা মামলা ৩ বছর, পিলখানা হত্যা মামলা ৭ বছর, সাতখুন মামলা ৩ বছর এবং পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলাটি ৬ বছর ধরে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা-সংক্রান্ত মামলা, মেয়ের হাতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলা, রাকিব হত্যা মামলা, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের মামলা, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা, সাংবাদিক মিশুক-মুনীর হত্যা মামলা, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলার আপিল সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যাশা শিগগিরই এসব মামলার আপিল শুনানি হবে।
জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার মো. সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘রাফি হত্যা মামলার রায়ের কপি হাইকোর্টে আসার পর ডেথ রেফারেন্স শাখায় দেয়া হয়েছে। এখন ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য নিয়মানুয়ায়ী পেপারবুক তৈরি করা হবে।
দ্রুত শুনানির বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।’ সাতখুন মামলার আসামি পক্ষে হাইকোর্টে শুনানি করেন আইনজীবী এসএম শাহজাহান। তিনি বলেন, ‘আপিল বিভাগে সাধারণত মামলা শুনানি হয় সিরিয়ালি।
এখন গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে হলে হাইকোর্টে যেভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হয়েছে সেভাবে আপিল বিভাগেও একটি বিশেষ বেঞ্চ করা যেতে পারে।’ আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি করে দ্রুত নিষ্পত্তি করা দরকার।
দীর্ঘদিন মামলাগুলো পড়ে থাকায় কারাগারে নির্দোষ ব্যক্তিকে বছরের পর বছর কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। অনেক সময় নির্দোষ ব্যক্তির বিচারিক আদালতে সাজা হয়। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।’
নারায়ণগঞ্জের সাত খুন : ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নুর হোসেন ও সাবেক তিন র্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ, মাসুদ রানাসহ ১৫ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন।
এরপর ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। রায়ের পর আসামিরা ন্যায়বিচারের আশায় সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন। বর্তমানে আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিশ্বজিৎ হত্যা : পুরান ঢাকার দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় দু’জনের মৃত্যুদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে দুই মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিসহ অন্যরা সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন। এই আপিলও শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্টে দেয়া ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল করেছেন কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ১৪ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এ আপিল দায়ের করেন।
ষোড়শ সংশোধনী : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেয়া রায় পুনর্বিবেচনার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০৮ পৃষ্ঠার এই রিভিউ আবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
আবেদনে রায় রিভিউর জন্য রাষ্ট্রপক্ষে ৯৪টি সুনির্দিষ্ট যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি এসব যুক্তির ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া পুরো রায় বাতিল চাওয়া হয়েছে।