মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:০৪ পূর্বাহ্ন
মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চান্দহর, বলধারা, জামির্ত্তা ও বায়রা ইউনিয়নের সানাইল চকসহ বিভিন্ন জায়গায় এক সময় হাজার বিঘা জমিতে ধানের আবাদ হতো। কিন্তু ফসলি জমির বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠেছে ইটভাটা। এসব ভাটায় ইট তৈরিতে ফসলি জমি থেকে অবাধে মাটি কেটে সাবাড় করছে একটি মহল।
এতে ফসলি জমি পরিণত হচ্ছে ডোবা, নালা, খাল, পুকুর ও জলাশয়ে। যার বিরুপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশ, কৃষি ও প্রাণী কূলে। জনস্বাস্থ্য পড়েছে হুমকির মুখে। এ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে মাটি কাটা বন্ধে এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট দফতরে বিভিন্ন সময় অভিযোগ দিলেও কোনো ভাবেই থামছে না ফসলি জমির মাটি কাটা। প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সিংগাইর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১০ বছর আগে উপজেলায় আবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৩৫৮ হেক্টর। বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ২৪৫ হেক্টরে। ইট ভাটা, কারখানা ও বসত বাড়ি নির্মাণের কারণে ৮শ ৫০ বিঘা জমি কমে গেছে। তবে এর চেয়ে আরও বেশি জমি আবাদহীন হয়ে পড়েছে বলে দাবি এলাকাবাসীর।
ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, উপজেলায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ৬০টি ইটভাটার মধ্যে বলধারা ইউনিয়নেই রয়েছে ২৯টি ইটভাটা। এছাড়া চান্দহরে ১০টি, বায়রাতে ৭টি, জামির্ত্তায় ৬টি, চারিগ্রামে ৩টি, সিংগাইর সদরে ৩টি ও ধল্লায় ২টি ইট ভাটা চালু রয়েছে।
ইট ভাটা মালিকদের দেয়া তথ্য ও স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ইট ভাটার প্রায় প্রত্যেকটিতে ৮ থেকে ১০ একর আবাদি জমি আটকে আছে। এ ভাটাগুলোয় মাটি সরবরাহের জন্য গত ১০ বছরে অন্তত কয়েকশ বিঘা আবাদযোগ্য জমির মাটি কাটা হয়েছে।
উপজেলার চান্দহর ইউনিয়নের রিফায়েতপুর খেজুরবাগান, বিলবাড়ির চক, বলধারা, খোলাপাড়া, হুনাখালি চক ও বায়রার সানাইল চকে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় দু’ডজন ইট ভাটা রয়েছে। এসব ভাটার চারপাশসহ পুরো এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় জলাশয়ের। যা ১০ বছর আগে ছিলনা।
সরেজমিনে সোমবার গিয়ে দেখা যায়, গোবিন্দল-জৈল্যা নতুন চর, মানিকদহ চক, বলধারা মৌজা, হুনাখালী চক ও সানাইল চকের একাধিক স্থানে কৃষি জমি থেকে ভেকু দিয়ে দিন-রাত সমান তালে মাটি কাটার দৃশ্য। খোলাপাড়া গ্রামের এএবি ব্রিকসের মালিক আব্দুল কুদ্দুস, এবিসি ব্রিকসের নূরুল হক কোম্পানি, এমআরএম ব্রিকসের মোয়াজ্জেম হেসেন, মাটি ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক, আলীমুদ্দিন, আনোয়ার, ফয়সালসহ একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ওই সব জমি থেকে মাটি কেটে ইটভাটায় নিচ্ছেন।
ফসলি জমি রক্ষায় ২০১৩ সালের পরিবেশ আইন ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছেন জমির মালিকসহ সচেতন এলাকাবাসী।
বলধারা ইউনিয়নের ছোট কালিয়াকৈর এলাকার আব্দুস সাত্তার, শহিদুল ইসলাম, পবিত্র কুমার, অনিল চন্দ্র রায় বলেন, আমাদের খেতের পাশে গভীর করে মাটি কাটায় আমাদের ফসলি জমি হুমকির মুখে রয়েছে।
চান্দহর ইউনিয়নের ওয়াইজনগর গ্রামের কৃষক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আমাদের রিফায়েতপুর-মাধবপুর চকটি ইটভাটার নগরীতে পরিণত হয়েছে। মাটি খেকোরা দিনের পরিবর্তে এখন রাতের আঁধারে মাটি চুরি করছে। গভীর করে ফসলি জমি থেকে মাটি কাটায় পার্শ্ববর্তী জমিও ভেঙে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
মানিক নগর গ্রামের ভুক্তভোগী জমির মালিক চান্দহর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. আনিসুর রহমান বলেন, আমরা গত পনের দিন আগে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর কৃষি জমি থেকে মাটি কাটা বন্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেও কোনো ফল পাচ্ছি না। আমাদের ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হোসেন বাদলের ইন্ধনেই এ মাটি কাটা অব্যাহত রয়েছে।
চান্দহর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত হোসেন বাদল বলেন, আমি সব সময়ই মাটি কাটা বন্ধের পক্ষে। আমার ইজ্জত নষ্ট করার জন্য একটা পক্ষ আমাকে জড়িয়ে বিভিন্ন কথা বলে বেড়াচ্ছে।
সিংগাইর উপজেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মাটি ব্যবসায়ী আব্দুল কুদ্দুস কোম্পানির সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।
চান্দহর ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. আব্দুস ছালাম বলেন, ফসলি জমি থেকে রাতের আঁধারে মাটি কাটার বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ টিপু সুলতান স্বপন বলেন, আমরা সব সময়ই কৃষকদের উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জমির শ্রেণি পরিবর্তন না করার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। তারপরও যদি কাটে আমাদের কি বা করার আছে। ইটভাটাসহ বিভিন্ন কারণেই প্রতিবছর ০.৭০ শতাংশ হারে ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে।
সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিপন দেবনাথ বলেন, আমরা ফসলি জমি থেকে মাটিকাটা বন্ধে সচেষ্ট আছি। ইতোমধ্যেই রাত সাড়ে ১১ টার দিকে বলধারা এলাকায় গিয়েও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি। সবাইকে সচেতন হতে হবে। গণসচেতনতা বৃদ্ধি করে কৃষি জমি রক্ষায় সবাই মিলে কাজ করলে একটা ভাল কিছু আশা করা যায়। তারপরও আমি এখনি এসিল্যান্ডকে বলছি ব্যবস্থা নিতে।