শনিবার, ২৪ মে ২০২৫, ০৭:১০ অপরাহ্ন
ছবি: সংগৃহীত
অনলাইন ডেস্ক: নারায়ণগঞ্জে আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের ৬ সদস্য র্যাবের হাতে আটকের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। পাচারকারী দলের সদস্যদের সাথে উদ্ধার করা হয়েছে চার তরুণী, বিপুল সংখ্যক পাসপোর্ট ও বিমান টিকেট।
উদ্ধার হওয়া এক নারী জানান, অভাব অনটনে সংসার চলাতে বাবা মায়ের কষ্ট হচ্ছিল। তখনই গ্রামের এক বোন বলে বিদেশ যাওয়ার জন্য। এর পরই এজেন্ট মো. অনিক হোসেন যোগাযোগ করতে শুরু করে। বলে বিদেশ যেতে কোন টাকা লাগবে না। পাসপোর্টসহ যাবতীয় খরচ তারাই বহন করবে। আর সেখানে গিয়ে ড্যান্স বারের শুধু মডার্ন ড্যান্স হবে এটাই কাজ। বিনিময়ে মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন, মোবাইল, স্বর্ণের চেইনসহ বিভিন্ন উপহারও পাওয়া যায়। এসব কিছু শুনে রাজি হই। এরপর তারা পোশাকসহ বিভিন্ন কেনাকাটার জন্য আমাদের ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দেয়। আর আমাদের ছবি তুলে নিয়ে যায়।
তিনি আরও জানান, ‘আমি কোন একাডেমী থেকে ড্যান্স শিখি নাই। তারা বলে সেখানে শিখিয়ে দিবে। পরে একটা হোটেলে ড্যান্স বারের মালিকের সঙ্গে দেখা করায়। এর কিছুদিন পর নির্দিষ্ট তারিখে বিদেশে নিয়ে যায়। বিদেশে যাওয়ার পর পাল্টে যায় পুরো চিত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তরুণী বলেন, বিদেশ নেওয়ার পর এয়ারপোর্ট থেকে একটি গাড়িতে করে নিয়ে একটি ফ্ল্যাটে আটকে রাখে তরুণীদের। প্রথম ১০দিন ড্যান্স বারে নিয়ে তাকে ড্যান্স করায়। কিন্তু এরপর থেকে অসামাজিক কাজ করতে বলে। এতে রাজি না হলে গালাগালি করে, মারধর করে, খাবার দেয় না, মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। এরপরও রাজি না হলে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে অসামাজিক কাজে পাঠায়। সব মেয়েকেই নেশা করিয়ে খদ্দরের কাছে পাঠায়।
তিনি আরও বলেন, ‘এর পর ড্যান্স করায়। খদ্দরের সঙ্গে কথা বলতে পাঠায় ও অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য করে। কিন্তু আমাদের ড্যান্সের জন্য কোন টাকা দেয় না। একজন খদ্দরের কাছে গেলে একটি টোকেন দেয়। এভাবে ৫০টি টোকেন জমা দিলে ৫০ হাজার টাকা দেয়। আর প্রতিটি মেয়েকে দিনে ৮ থেকে ১০টি টোকেন নেওয়ার জন্য বাধ্য করে।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে অন্য আর এক নারী বলেন, ‘বাংলাদেশি অনেক মেয়ে দুবাইতে আছে। তাদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কেউ গর্ভবতী হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের কোন চিকিৎসা দেওয়া হয় না। তাদের দেশেও পাঠায় না। এনিয়ে এজেন্টদের কাছে বলতে গেলে উল্টো গালাগালি শুনতে হয়। তারা বলে, কোম্পানি টাকা দিয়ে এনেছে। তারা যা বলবে তাই করতে হবে। এজন্য অভিযোগ দিয়েও কোন কাজ হতো না। এছাড়া এজেন্টরা যখন মনে করে তাকে দিয়ে কাজ হবে না তখনই দেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু দেশে ফিরে তাদের নাম ঠিকানা পাওয়া যায় না তাই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এছাড়া মান সম্মানের ভয়েও যাওয়া হয় না।
তিনি বলেন, ‘আমি চাইনা আমার মতো আর কোন মেয়ে এভাবে প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে জীবন শেষ হোক। তাই কেউ বিদেশ গেলে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে যেনো যায়। আর সরকারের প্রতি অনুরোধ এসব প্রতারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।’
অভিযানের নেতৃত্বে দেওয়া র্যাব-১১ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. আলেপ উদ্দিন জানান, তরুণীদের প্রাইভেট সার্ভিস দেখিয়ে টুরিস্ট ভিসায় বিদেশে নেওয়া হতো। আবার ভিসার মেয়াদ শেষ হলে সিন্ডিকেটই আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। পরবর্তীতে তারা আবারও তাদের প্রলোভন দেওয়া শুরু করে এবার এমন হবে না। শুধু ড্যান্স করবে। এতে রাজি না হলে মানসিকভাবে ব্লকমেইল করতে শুরু করে। পরে এ তরুণীরাও এক পর্যায়ে দ্বিতীয় বার যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যায়।
তিনি বলেন, এ চক্রে দেশে বিদেশে ৫০জনের অধিক সদস্য রয়েছে। এরা বিগত এক বছরের ৭২৯ জন তরুণীকে বিদেশে পাঠিয়েছে। যার মধ্যে শুধু মাত্র নারায়ণগঞ্জেরই ২ শতাধিক তরুণী রয়েছে। এ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।
গত রবিবার বিকালে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী এলাকার র্যাব-১১ এর সদর দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-১১ এর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক স্কোয়াড্রন লিডার ইঞ্জিনিয়ার মো. রেজাউল হক। তিনি জানান, এ সকল মানব পাচার চক্রের উপর দীর্ঘদিন যাবৎ র্যাব-১১ গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে আসছিল। এর ধারাবাহিকতায় গত শনিবার রাতে রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো মোড়ের শাহ চন্দপুরী রেস্টুরেন্টে র্যাব-১১ অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে। আটককৃত আসামিদের কাছ থেকে ৭০টি পাসপোর্ট, নগদ ১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, ২০০টি পাসপোর্টের ফটোকপি, ৫০টি বিমান টিকেট, ৫০টি ট্যুরিস্ট ভিসার ফটোকপি, একটি সিপিইউ, একটি মনিটর ও একটি অত্যাধুনিক বিলাসবহুল মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়। এসময় তাদের হেফাজত থাকা ৪ জন তরুণীকে উদ্ধার করা হয়।
আটককৃতরা হলো, তরুণী সংগ্রহকারী এজেন্ট মো. অনিক হোসেন (৩১), মো. আক্তার হোসেন (৪০), পাসপোর্ট প্রস্তুতকারী দালাল মো. আফতাউল ইসলাম ওরফে পারভেজ (৩৭), দুবাইয়ের ড্যান্স ক্লাবের মালিক মো. মনির হোসেন ওরফে সোহাগ (৩০) ও আ. হান্নান (৫২) ও মবিন ট্রাভেল এজেন্সির মালিক মো. আকাশ (২৯)।
মো. রেজাউল হক জানান, আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী সুন্দরী তরুণীদের উচ্চ বেতনে বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে থাকে। এই পাচারকারী সিন্ডিকেটের সাথে বিপুল সংখ্যক এজেন্ট, পাসপোর্টের দালাল, ড্যান্স বারের মালিক, ট্রাভেল এজেন্সি ও অসাধু ব্যক্তি যুক্ত রয়েছে। এই নারী পাচারকারী সিন্ডিকেটের এজেন্টরা নিম্নবিত্ত পরিবারের, পোশাক শিল্পের, ব্রোকেন ফ্যামিলির সুন্দরী তরুণীদের প্রাথমিকভাবে টার্গেট করে থাকে। টার্গেট করার পর প্রথমে তরুণীদের ছবি বিদেশে অবস্থিত ড্যান্সবারের মালিককে পাঠানো হয়। ছবি দেখে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর ড্যান্স বারের মালিক অথবা তার প্রেরিত প্রতিনিধি সরাসরি উক্ত তরুণীদেরকে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে ঢাকা অথবা আশেপাশের কোন রেস্টুরেন্ট, হোটেল অথবা লং ড্রাইভের নামে অত্যাধুনিক বিলাসবহুল মাইক্রোবাসে সাক্ষাৎ করে থাকে। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত তরুণীদের পাসপোর্ট উক্ত নারী পাচারকারী সিন্ডিকেট তাদের নিজস্ব পাসপোর্ট দালালের মাধ্যমে প্রস্তুত করে থাকে। ট্রাভেল এজেন্সির মালিকের মাধ্যমে নথিপত্র ম্যানেজ করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এই সকল তরুণীকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করে থাকে।
আটককৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, এ সকল তরুণীরা বিদেশে পৌঁছা মাত্র এয়ারপোর্ট থেকে উক্ত সিন্ডিকেটের সদস্যরা রিসিভ করে হোটেলে নিয়ে গৃহবন্দি করে রাখত। বিদেশে অবস্থানকালীন সময়ে এই সকল তরুণীকে কোন অবস্থাতেই নিজের ইচ্ছায় হোটেল তথা ড্যান্স বারের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। প্রাথমিক অবস্থায় তরুণীরা এসব আসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে রাজি না হলে বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য জোরপূর্বক প্রয়োগ করা হয়ে থাকত। এভাবে দিনের পর দিন উক্ত তরুণীদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন চলতে থাকে।
কোন খদ্দরের কোন নির্দিষ্ট তরুণীকে পছন্দ হলে উক্ত ড্যান্স বারের মালিকের নিকট হতে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কয়েক দিনের জন্য ভাড়া নিয়ে থাকে। এভাবেই নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণীদের সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রলোভনে ফেলে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে বলে র্যাবের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
দৈনিকবিডিনিউজ৩৬০/এসএম