গত ১২ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, পাঁচ প্রতিষ্ঠানের করোনা পরীক্ষার অনুমোদন বাতিল করেছে তারা। এসব প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো কেয়ার মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল, সাহাবুদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল, স্টেমজ হেলথ কেয়ার, থাইরোকেয়ার ডায়াগনস্টিক এবং চট্টগ্রামের এপিক হেলথ কেয়ার। কোভিড-১৯ আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের অনুমোদন স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধিদফতরের মহাপরিচলক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা।
কিসের ভিত্তিতে তাদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সব ডকুমেন্ট দেখেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল স্থগিত করা পাঁচটি ল্যাবকে। পরবর্তীতে এসব ল্যাব কার্যক্রম শুরু না করায় কারণ দর্শানো হয়। জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় অনুমোদন সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ‘সরল বিশ্বাস’
রিজেন্ট এবং জেকেজির ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, একটি মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতারিত হয়েছে।
বলা হয়, ওভাল গ্রুপ স্বাস্থ্য সেবা সপ্তাহ ২০১৮-এর ইভেন্ট এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে। ওভাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জেকেজি বুথ স্থাপন করে করোনার নমুনা পরীক্ষা করতে চায় বলে জানায়। তারা বলে, এ জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর বা সরকারকে কোনও অর্থ দিতে হবে না। ধারণাটি ভালো এবং প্রতিষ্ঠানটির কাজের সঙ্গে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় জেকেজিকে অনুমতি দেওয়া যায় বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর মনে করেছে। কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণা করতে পারে এমন ধারণা আদৌ ছিল না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র আয়েশা আক্তার বলেন, ‘দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না, আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সরল বিশ্বাসে রিজেন্ট এবং জেকেজিকে কাজ দিয়ে আমরা অধিদফতর প্রতারিত হয়েছি।’
ল্যাব বাড়ানোর দরকার ছিল, কিন্তু এভাবে নয়
করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে পরীক্ষা করা, রোগী শনাক্তসহ পুরো বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানিয়েছে আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা একাধিকবার জানিয়েছেন, করোনা পরীক্ষার জন্য প্রতিটি ল্যাব হতে হবে মানসম্পন্ন। প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্ট, ল্যাবের জন্য উপযুক্ত যন্ত্র, উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। তবে তখন সে নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়, বলা হয় আইইডিসিআর নিজের হাতে পরীক্ষার সুযোগ রাখতে চায়, এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এ কথা বলা হচ্ছে।
গত ৪ মে পরীক্ষা থেকে তাদের নমুনা পরীক্ষা করার কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তখনকার অতিরিক্ত সচিব ও কোভিড-১৯ বিষয়ক মিডিয়া সেলের প্রধান হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, তাদের পক্ষে অসংখ্য টেস্ট করতে গিয়ে স্যাম্পল কালেকশন একটা অতিরিক্ত চাপ হয়। যেটা তাদের জন্য ভালো হয়, সেটাই তারা করবে।
ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রথম থেকেই দরকার ছিল-মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘তারা (অধিদফতর) চেষ্টা করেছে। কিন্ত পিসিআর টেস্ট করা কঠিন। এটা এমন না যে পিসিআর মেশিন থাকলেই করা যাবে। বরং যারা এ পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের দক্ষ হতে হবে। দক্ষ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের অভাব শুরু থেকেই ছিল। এই দক্ষতার অভাবের কারণেই অনেক রিপোর্ট নিয়ে আমরা অভিযোগ শুনেছি। এটা খুবই সুক্ষ্ম ব্যাপার। একটু এদিক ওদিক হলেই ফলাফল ঠিক থাকবে না, আবার অনেকে করতেও পারবেও না।’
ল্যাবরেটরির অনুমোদন দিয়ে সেগুলোকে পরে স্থগিত করে দেওয়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের খামখেয়ালিপনা উল্লেখ করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যাদের লাইসেন্স নেই, সেসব হাসপাতাল বা জেকেজির মতো প্রতিষ্ঠানকে সরকারি তালিকায় করোনার মতো মহামারির মধ্যে কাজের অনুমোদন দেওয়ার পরিণতি আজ জাতি দেখছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়ে কতটা ভয়ংকর কাজ করে তারা সেটা এখন আর বলার অপেক্ষাই রাখে না। এসব জায়গাতে মানুষের চিকিৎসায় গাফিলতি হয়, মারা যায়-এসবের দায়িত্ব কে নেবে। করোনা এসে হেলথ সেক্টরের রুগ্ন, ভগ্ন দশা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। তবে তার জন্য দায় নিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।‘
শৃঙ্খলা নেই স্বাস্থ্যখাতে
‘স্বাস্থ্য অধিদফতর সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ছেলেখেলা করছে’ বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘করোনাকালে সবকিছু কঠিনভাবে মনিটর করা উচিত ছিল, যেটা করতে স্বাস্থ্য অধিদফতর ব্যর্থ হয়েছে। এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।’
জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস বলেন, ‘শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কাজ করা যাচ্ছে না, ব্যবস্থা নেই। সে ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। এখন কোনও কিছুর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। রিপোর্টের নিয়ন্ত্রণ নেই, কারও কথার নিয়ন্ত্রণ নেই, কার সঙ্গে কার চুক্তি হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে সেগুলোর কোনও জবাবদিহিতা নেই। এর মধ্যে দিয়েই মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে, অ্যান্টিবডি গ্রো করছে, ইমিউনিটি বাড়ছে-এভাবেই চলছে। কিন্তু সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান এমন কাণ্ড করার পর বলবে-সরল বিশ্বাসে তাদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল এবং তারা প্রতারণা করেছে, যেটা তারা আগে বোঝেনি-এর কোনও ভিত্তি নেই। এটা দায় এড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়।’
এসএস